অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)

অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

 

 

(১২)

খসখস শব্দটা বেড়েই চলেছে। যেন কোনো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে আসছে কেউ। হিংলা সন্তর্পণে এগোচ্ছিল। পিছন থেকে এরকম একটা শব্দ শুনে ঝপ করে একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে পড়লো। বেশ কিছুটা দূরে দেখলো একই রকম আরো একটা পথ ডান দিক থেকে এসে তার পথের সাথে মিশেছে। একজন মানুষ ওই পথ দিয়েই এগিয়ে আসছে। একটু কাছে আসতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। এ যে পিংলা! তার ভাই বেঁচে আছে? কিছুই হয়নি তার- কি সুন্দর হাঁটছে! হিংলা চিৎকার করে তাকে ডাকতে গিয়েও পারল না। সে এরপর যে দৃশ্য দেখে ফেলেছে, তাতে তার হাত পা রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা মানুষকে টেনে টেনে পিংলা নিয়ে যাচ্ছে। কি হারহিম করা দৃশ্য! কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে? হিংলার কিছু মাথায় ঢুকলো না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো এবং একটু তফাতে থেকে তার ভাইকে অনুসরণ করতে লাগলো। লোকটা ঘষটে ঘষটে চলেছে.. বেঁচে আছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। হঠাৎ হিংলার মাথাটা ঘুরে গেলো। লোকটির জামার রংটা তো..এ যে দাদাবাবু! সে আর এক মুহূর্ত ভাবতে পারলো না। মনের সমস্ত জোরকে একজায়গায় করে
শ্বাস রুদ্ধ করে অনুসরণ করতে লাগলো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। একটু দূরেই একটা পুরোনো কাঠের বাড়ি দেখতে পেলো হিংলা। বেশ বড় বাড়ি। কাছাকাছি যে সমুদ্র রয়েছে সেটা হিংলা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে। পিংলা আহানকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িটার ভিতরে ঢুকে গেল। হিংলা কাকেই বা খবর দেবে আর কিভাবেই বা খবর দেবে! ভেবেও কোনো উপায় বার করতে পারলো না। এই অবস্থাতে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অগত্যা সে পিংলার পিছু পিছু ঘরটার ভিতরে ঢুকে পড়লো

(১৩)

ওদিকে আহান আর হ্যালি ধীরে ধীরে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। কিছুদুর এগিয়েই তারা দেখলো সামনের পথটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাওয়া যায়! হ্যালি বললো, “তুই বাঁ দিকটা দেখ আমি ডান দিক দিয়ে এগোচ্ছি। কোনো বিপদের গন্ধ পেলেই সিগন্যাল দিয়ে দিস..” আহানও আর আপত্তি করলো না। আহান ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে বোলাচ্ছিলো সে। হঠাৎই বেশ খানিকটা দূরে লোকটিকে দেখতে পেলো। যে সাধুর সাথে কথা বলছিল আহানের দিকে পিঠ করে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। আহান বার দুয়েক ডাকলো লোকটাকে, কিন্তু লোকটা যেন একবারও শুনতেই পেলো না। আহান এবার তাড়াতাড়ি পা চালায়।একে যেভাবেই হোক ধরতে হবে। সে ঠিক লোকটির পিছনে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “ও ভাইয়া,শুনাই নাহি দে রাহা হ্যায় কেয়া?”
আহানের কথায় এবার সে পিছন ঘুরে তাকালো। কিন্তু কি অদ্ভুত! চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের স্থির। আহনকে দেখেও মুখোভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। হঠাৎ করে সে জাপটে জড়িয়ে ধরে আহনকে। এরকম যে হতে পারে আহান কল্পনাও করে পারেনি। বিন্দুমাত্র গলার স্বর বের করতে পারল না। দম যেন ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। দু’ একবার চেষ্টা করলো কানের দুলটা স্পর্শ করে হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠানোর। পারলো না..একটা সময় লোকটি বাঁধন আলগা করে দিলো..আহান লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটি আহনকে টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে চললো।

(১৪)

এদিকে হ্যালি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে সে পথের মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, “আরে এ তো গাড়ির চাকার দাগ, জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি কোথা থেকে এলো?”
এবার ও ওই দাগ ধরে এগোতে থাকলো। বেশ কিছুটা এগিয়ে সে দূরে একটা পুরনো কাঠের বাড়ি দেখতে পায়। এখন সে নিশ্চিত ! যে এখানে কোনো না কোনো গুপ্ত কাজকর্ম নিশ্চই হয়। ধীরে ধীরে হ্যালি বাড়িটার সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই কেন? কোনো দরজাও নেই! এটা কি পিছন দিক? সে ঠিকই ধরেছে। একটু সামনের দিকেই বড়ো দরজা দেখতে পায় হ্যালি। ওখানে বেশ কয়জন ঘোরাঘুরিও করছে। ওদের চলাফেরা কেমন যেন যন্ত্রের মতো। কাছেই দু’টো জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। এখন হ্যালির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পরিস্কার বলছে কিছু একটা হতে চলেছে। সে তাড়াতাড়ি কানের ঝুমকোটার হালকা নিচের দিকে টেনে কি সব যেন ফিসফিস করে বললো।
আহানের কাছে থেকে আগে শুনেছিল এরকম কোন পরিস্থিতিতে সবকিছু ভালো করে দেখে শুনে তারপর পদক্ষেপ নিতে হয়। তাই বাড়িটার ভিতরে ঢোকার কথা ভেবেও হ্যালি থমকে দাঁড়ালো। ঠিক তো জায়গাটা আগে ভালো করে জেনে নেওয়া ভালো। ওদিকে অন্ধকারও হয়ে এসেছে। সারাদিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে পাগুলো একটু লাগছে। তাই হ্যালি চটজলদি বাড়িটার একটু পাশে একটা বড় গাছের ওপর উঠে বসলো। এখন থেকে বাড়িটার সামনে পিছনে দুটোই ভালো করে লক্ষ্য করা যাবে। মাথায় তখন ঘুরছে.. কি হয় জঙ্গলের ভিতরে? কি আছে এই বাড়িটাতে? তাহলে কি সত্যি সেই দিন সেই ব্ল্যাকমেইল চিঠিটার চামড়াটা কোনো মানুষের ছিল? আহনকে কথাটা বলবো বলবো করে বলাই হয় নি। ভাবনায় ব্যাঘাত পড়লো যখন হঠাৎ শুনতে পেল কাছে কোথাও জাহাজের সাইরেন বাজছে।

(১৫)

আহানের কানের দুলটা বারবার করে আহনকে হালকা একটা ইলেক্ট্রনিক শকের মতো দিচ্ছে। একটা মেয়ের গলা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” অবশ্য এই কথাটা শুধুমাত্র আহানই শুনতে পাচ্ছে।
আহানের ততক্ষণে হালকা হালকা জ্ঞান ফিরেছে। ভালো মতো বুঝতে পারছে ওকে একটা ঘরে রাখা হচ্ছে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে মনে হচ্ছে কি যেন একটা পড়ে আছে। ওঠার চেষ্টা করলো, না.. হাতগুলো পিছনে মুড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা.. পা’টাও বাঁধা.. চোখটা হালকা ধাতস্থ হয়ে গেছে অন্ধকারে। জিনিসটা কেমন নড়ে উঠলো না! কোনোরকমে নিজেকে টানতে টানতে আহান জিনিসটার কাছে এলো। আরে এ জিনিস কৈ? এত হিংলা! ও এখানে কি করে এলো? হ্যালি কোথায়? হঠাৎ কানে আবার একটা হালকা ইলেক্ট্রনিক শক সাথে সেই মেসেজটা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” যতক্ষণ না আহান কোনো উত্তর দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে এরকম শক দিয়ে যাবে। আহান আস্তে আস্তে হিংলাকে ডাকলো, “হিংলা উঠ.. তু ইধার ক্যায়সে আয়া?” আহানের দু-তিনবার ডাকায় হিংলাও একটু নড়েচড়ে উঠলো। “দাদাবাবু! তুমি ঠিক হ্যায় না? দিদিমণি কিধার হ্যায়?” হিংলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও একটা জাহাজের সাইরেনের শব্দ দুজনকেই বেশ আশ্চর্য করে তুললো।

(১৬)

জানি না এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে। ওদিকে আহানেরও কোনো উত্তর আসছে না। হ্যালি একটু বিচলিত হয়ে পড়লো। পূর্ণিমার চাঁদ ততক্ষণে মধ্য গগনে বিরাজমান। চারদিকটা বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে আরো দু’টো জিপ আসে দাঁড়ালো বাড়িটার সামনে। বাড়ির ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন বড়ো বড়ো দুটো কাঠের কফিনের মতো কিছু গাড়িতে তুলে দিল। জিপ দু’টো যেদিক দিয়ে এসেছিল আবার সেই দিকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।
হঠাৎ একটা হাল্কা ইলেক্ট্রনিক শক হ্যালিকে আবার উত্তেজিত করে তুললো। আহান reply দিয়েছে !
“আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে… বিপ বিপ…. আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে.. we are trapped ” ব্যাস কেটে গেল। সিগন্যাল প্রবলেম.. আর কিছু শোনা গেল না।

হ্যালি এবার আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে এলো। বাড়ির ভিতরের সব আলোগুলো ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। খুব সন্তর্পণে হ্যালি জিপ গাড়িগুলো যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে এগিয়ে চললো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। আস্তে আস্তে জঙ্গলটা কেমন যেন শেষ হয়ে আসছে‌। দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে নীল জলরাশি যেন হ্যালিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই তো দূরে জিপ গাড়ি দু’টো তখন দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই একটা বেশ বড় মতো স্টীমারও দাঁড়িয়ে। বেশ কিছু লোকজনও রয়েছে। অন্ধকারে এত দূর থেকে ভালো করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নাহ্, আর কাছে যাওয়া যাবে না। ওদিকে সমুদ্র সৈকতে ধু ধু বালির ওপর কোথাও লোকানো যাবে না। অগত্যা এখানে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

(১৭)

হিংলার সাহায্যে নিজের হাতের বাঁধনটা খুলে তরিতঘড়িত হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠালো আহান তারপর নিজের পায়ের বাঁধন সাথে হিংলাকে বাঁধনমুক্ত করে ঘর থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজতে লাগলো। না, এরা অতটাও বোকা না। ঘরে কোনো জানালা নেই, একটাই দরজা সেটাও বাইরে থেকে বন্ধ। কেউ যেন ওদের ঘরের দিকেই আসছে। দুজনে দরজার দুই ধারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে থাকলো। ওদের ঘরের বাইরে কেউ যেন কাউকে বলছে, “শুন আজ দো আদমি আয়ে না.. উন যে সে জো শহরকে আদমি আছে উস্কো হামলোগ ইধার রাখ দেঙ্গে। দেখ কর বহুত সেয়ানা লাগতে হ্যায়। বাদমে বাহুত কাম আয়েগা। দুসরে কো চালান কর দেঙ্গে। নাজার রাখ দোনোকে উপর। কাল শুভা শহরওলা আদমি কো লাবরেটরি মে লেকের আনা। থোড়া রিসার্চ কারনা হ্যায়…..” বলে লোকটা যে দিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে আবার চলে গেল।

“গলার আওয়াজটা কেমন চেনা চেনা লাগলো না দাদাবাবু?” হিংলার এই কথাটা আহানের অনেক আগেই মাথায় স্ট্রাইক করেছে…”হু” বলে একটা সম্মতি জানায় আহান। কোথায় শুনেছে এই গলাটা? হঠাৎ মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল “আরে এটা তো সাধুর গলা না!”
“তার মানে সাধুটাই আসল কালপ্রিট! কিন্তু লাবরেটরি কেন? কিসের চালান? কোথায় চালান করবে হিংলাকে” এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ভোর হয়ে গেছে আহান খেয়াল করে নি। হিংলা একটু দূরে ঘুমে কাতর। হঠাৎ কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিলো। একজন ভিতরে প্রবেশ করলো, আরে! এটা কি সত্যি সেই সাধুটা? উহু! তা কি করে হয়? এর তো পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। সাধুর তো পরনে ধুতি ছাড়া কিছু ছিল না! তাহলে কি এ সাধুটার যমজ ভাই? নাহ্ ব্যাপারটা দেখতেই হচ্ছে! লোকটা এখন আহানের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আহানও এক দৃষ্টে সাধুটাকে দেখছে। এ যেন এক ঠাণ্ডা লড়াই। হঠাৎ লোকটা দু’টো চেলাকে বললো, “ইসকো লে চলো, টাইম নেহি হ্যায় হামারে পাশ” কথাটা শেষ হতে না হতেই দু’টো চেলা এসে আহনকে জাপটে ধরলো। রীতিমতো ঠেলা দিতে দিতে ওকে নিয়ে এলো দোতলার একটা কোণের দিকে ঘরে। বেশ বড়ো ঘরটা- নানা রকম মেশিন, কেমিক্যাল, লাবরেটরির টুকটাক জিনিসে ভর্তি।
আহান আসতে আসতে খেয়াল করেছে বাড়িটার আরো পাঁচ থেকে সাতটা ঘর আছে। সব ঘরই বাইরে থেকে তালা বন্ধ।আশেপাশে কম করে দশটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যন্ত্রের মতো যে যার কাজ করছে।
“ইধার বিঠাও উস্কো” লোকটার গম্ভীর আওয়াজে আহানের সম্বিৎ ফিরলো। দুই চেলা ততক্ষণে ওকে চেপে ধরে একটা চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। একটু অদ্ভুত রকমের এই চেয়ারটা। কত ইলেক্ট্রিক তার।

(১৮)

সারারাত একভাবে ঠায় সমুদ্রের কিনারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে খেয়াল করে নি হ্যালি। আশেপাশেটা একবার ঝট করে দেখে নিয়ে ছুটলো জিপগুলোর দিকে। লোকগুলো সব মরার মতো ঘুমাচ্ছে। ওদিকটায় স্টীমারটাও দাঁড়িয়ে। লোকগুলোকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে, নিজের নাকে একটা রুমাল চাপা দিয়ে নিজের পিঠের ব্যাগ থেকে একটা কিছুর স্প্রে বার করে লোকগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে দিলো- ক্লোরোফর্ম ! দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো স্টীমারটার দিকে। এই রে একটা লোক উঠে গেছে! হ্যালির দিকে পিছন ফিরে সমুদ্রের দিকে কি যেন দেখছে। হ্যালি চুপি চুপি গিয়ে লোকটার ঘারের কাছে এক রদ্দা মারলো। লোকটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটাকে ডিঙিয়ে হ্যালি এবার স্টীমারের সব ঘরগুলো সার্চ করতে থাকলো। ওর জায়গায় আহান থাকলে ঠিক এভাবেই করতো নিশ্চয়ই। না, কোথাও আর কেউ নেই। স্টিমারের একটা জায়গার মেঝেতে পা দিতেই কেমন যেন নড়ে উঠলো সুড়ঙ্গ পথ! তারমানে গুপ্ত কক্ষ আছে স্টীমারটায়। একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে নেমে পড়লো হ্যালি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ। একটু যেতেই হ্যালির কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো। যত এগোচ্ছে ততই যেন ঠান্ডা ভাবটা বাড়ছে। একটু এগিয়েই একটা ঘর দেখতে পেলো, না ঠিক ঘর না। একটা কোল্ড রুম, কিন্তু এখানে কোল্ড রুম কেন? দু’বার না ভেবেই ঢুকে পড়ল হ্যালি। চারপাশে সব বড়ো বড়ো ডীপ ফ্রীজার। একটা ফ্রীজের ঢাকনা খুললো। তারপর আবার একটা.. এই করতে করতে প্রায় সব ফ্রীজেরই ঢাকনাগুলো খুলে ফেললো হ্যালি। রক্ত জল করে দেওয়ার দৃশ্য। এত human অর্গান! এগুলো আসে কথা থেকে? এরাই বা এগুলো পায় কথা থেকে! নাহ্, সময় নষ্ট করলে চলবে না। কানের দুলটা থেকে আবার একবার বিদ্যুৎ খেলে গেল… আহানের মেসেজ.. ” be carefull .. be carefull.. Apply Plan B “

(১৯)

লোকটা এবার এগিয়ে আসছে আহানের দিকে। চেলাগুলো এতক্ষণে ওকে ছেড়ে দিয়ে একটা দিকে সরে গেছে। আহান নিজের মনের সব জোরটা দিয়ে এক দৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। একটু পরেই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যাক অপেরাশন successfull বাঁচার একটাই পথ খোলা ছিল “হিপনোটাইজ” কিন্তু যারা এই কৌশলটা আগে থেকে জানে তাদের করা একটু শক্ত ব্যাপার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি হলো ব্যাপারটা! আহান একটু হকচকিয়ে গেল। তার মানে ও যেটা ভেবেছিলো সেটাই সত্যি, এই লোকটা ওই সাধুটার যমজ ভাই। নাহ্, হাতে একদম সময় নেই। হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠিয়ে, আহান ছুটলো নিচে অন্য ঘর গুলোর দিকে। বাইরে বেরোনোর আগে সবটা দেখে শুনে নেওয়াই ভালো। নীচে ততক্ষণে হিংলাও দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বদ্ধ ঘরটা থেকে। লোকটাকে এভাবে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে বাকি যান্ত্রিক মানুষগুলোর মধ্যে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব… সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। সব ঘরগুলোই ওই যান্ত্রিক মানুষগুলোর থাকার ঘর। কিছু নিজেদেরও জন্যও বটে। পিঠের ব্যাগটা থাকলে না হয় মাস্টার কি দিয়ে দরজাগুলো খুলে দেখা যেত। কিন্তু ব্যাগটা এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ব্যাগটাকে খোঁজার জন্য তখন আহান আকুল। হিংলা বারবার বললেও আহানের সে সাবধানবাণীতে কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ ওরা দুজন তুলনামূলক একটা বড়ো ঘরে ঢুকলো। অনেকটা অপারেশন থিয়েটারের মতো। এখানে অপেরাশন থিয়েটার কেন? আহানের মনে হচ্ছে সত্যি এবার ও পাগল হয়ে যাবে! খালি চারদিক থেকে কি? কেন? কেন হচ্ছে? সব যেন ওকে গিলে খেতে আসছে। ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। এতক্ষণে ওরা বাড়িটার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হ্যালিও হাজির ওদিক থেকে। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা গুলি হ্যালির কাঁধের ফাঁক দিয়ে এসে সোজা আহানের কলার বনে লাগলো। হ্যালি বা হিংলা কেউ কিছু বোঝার আগেই আহান মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আরো একটা গুলি চলতে যাচ্ছিল হ্যালিকে উদ্দেশ্যে করে হঠাৎ করে জঙ্গলের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে ঝাঁক ঝাঁক পুলিশ আর স্পেশাল ফোর্স এসে বন্দুকধারী ব্যক্তিটিকে ঘিরে ধরলো। আরে এত সাধুবাবা! আর তার একনিষ্ঠ চেলা পিংলা।

(২০)

যখন জ্ঞান ফিরলো, আহান তখন হসপিটালের বেডে শুয়ে। হ্যালি ওর পাশেই বসে। পিছনে হিংলা দাঁড়িয়ে, ডক্টর এসে সব checkup করে গেল। হিংলার মুখ দেখে এবার আহান হেসেই ফেললো। রীতিমত ছানার বড়ার মতো বড়ো বড়ো চোখ করে হিংলা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহানই শুরু করলো কিভাবে ও আর হ্যালি একে অপরকে সাথে যোগাযোক করে এবং কি ভাবে ওরা প্ল্যান B apply করে পুলিশকেও সিগন্যাল পাঠায়। কিভাবে দুই যমজ ভাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো এক কথাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে যান্ত্রিক মানুষ আর মানুষের অঙ্গ বেচার কাজ সুনিপুণ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। কিভাবে দুই ভাইয়ের একজন অতিপরিচিত তান্ত্রিক সাধু হয়ে উঠেছিল জনসমক্ষে আর অপরজন সুদক্ষ বিজ্ঞানী সাথে সুনিপুণ শল্য চিকিৎসক। কিভাবে বিভিন্ন হোটেল আর রিসর্টের মালিকদের কখনো টাকা কখনো বা ভয় দেখিয়ে নিজেদের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিলো। কিভাবে মানুষের রক্ত খেকো বাদুড়দের কাজে লাগিয়ে পর্যটক বা নিরীহ মানুষকে ভুতের ভয় দেখাতো। কিভাবে শক থেরাপি সাথে কিছু ওষুধের মাধ্যমে মানুষদের যন্ত্র মানবে পরিণত করতো। কিভাবে স্টিমারে গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রের দ্বারা অঙ্গ বিক্রির কাজ চলতো। কথার রেশ কাটলো যখন ডাক্তার এসে বলে গেল যে পিংলা সহ বাকি যান্ত্রিক মানুষদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে ট্রেটমেন্টের জন্য। হিংলা চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো নিজের ভাইকে একবার দেখার জন্য।

(২১)

হসপিটালের কেবিনের মধ্যে এখন এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতা।
নিস্তব্ধতা কাটলো যখন লোকাল থানার ও.সি সহ একটা পাঁচ-সাত জনের পুলিশ ফোর্স এসে স্যালুট করে “স্যার” এবং “ম্যাডাম” বলে দাঁড়ালেন। ওদিকে যান্ত্রিক মানুষগুলোর এরপর কি হবে, কালপিট দুটোরই বা কি হবে সাথে আরো হাজারো প্রশ্ন……সবকিছু কাটিয়ে আবার যে নিজের নিজের দৈনিক জীবনে ফেরার বিষন্নতা ওদের দুজনের মাথাকেই হ্যাং করে দিচ্ছে বারবার।
নিজের নিজের ফোনের টিং টিং শব্দে ওদের দুজনেরই সম্বিৎ ফিরলো…

” Your flight ticket has successfully booked, Have a happy trip.”

সবার অজান্তেই ওদের দুজোড়া চোখ আবার একবার চিকচিক কৰে উঠলো।

-সমাপ্ত-

Loading

Leave A Comment